প্রতীকী ছবি।
এম এ মান্নান
তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তাম। আব্বা আমাকে কুমুরিয়ার ডেবরা মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়তে দিয়েছিলেন। বুইদ্যা নানার দোকান ঘরের বারান্দায় বসে জীবন মামা আর আমি ডেবরা স্যারের নিকট বাংলা পড়তাম। স্যার খুব ভাল পড়াতেন। পড়া না পারলে শ্লেটের কোণা দিয়ে পায়ের সামনে হাঁড়ের মধ্যে টুক টুক করে পিটাতেন। এতে পড়া শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ, ক্লাসে না গিয়েও রক্ষা পাওয়া যেতো না। মেঝভাই স্যারের কাছে ধরে নিয়ে যেতেন। একদিন না গেলে স্যার নিজেও বাড়িতে চলে যেতেন। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন আমি পুরা বাংলা রিডিং পড়তে পারতাম। বানানের এত মাহের ছিলাম যে, পরীক্ষায় হাজার শব্দের মধ্যে আমার ২/১টি শব্দের বানানও ভুল হতো কিনা জানা নেই। তখন থেকেই হাতের লেখাও মোটামুটি সবার মধ্যে ভাল ছিল। উপরের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদেরকে পড়া বলে দিতাম। এসব খবর যখন ছড়িয়ে পড়ল ও আব্বার কানে যেতে লাগল। সম্ভবত: তখন থেকেই আব্বা আমাকে বেশি ভালবাসতে লাগলেন। প্রথম টের পেলাম কিভাবে? বাড়ির সামনে এখন যে জায়গাটাতে ছোট ভাই আব্দুল হান্নানের দু’তলা বিল্ডিং হচ্ছে, ঠিক সেখানে একবার বেগুণ খেত করা হয়েছিল। বড় ভাইসহ সকাল বেলায় সবাই বেগুণ খেতে ঘাস বাছতেছিলাম। আব্বা বাড়ি এসে দেখে ফেললেন। বললেন, এই তুই উঠ। তুই বাছতে পারবে না, উঠ। অথচ এর আগে আব্বার সাথেই আমি অনেকবার খেত বাছা, রোয়া লাগানো, ধান কাটা ও হাল চাষের কাজ করেছি। সেদিন এভাবে বলাতে আমার প্রথম অনুমান হলো যে, আমি খেত বাছতে পারি না এমনটি নয় বরং আব্বা আমাকে আদর করে খেত থেকে উঠিয়ে দিয়েছেন। এরপর একদিন ছারছীনা মাদরাসা থেকে বাড়ি এসে পুকুরের পাড়ে আম গাছে উঠেছিলাম আম পাড়তে। কোথায় থেকে যেন আব্বা এসে দেখে ফেললেন। আমি আম গাছের আগডালে। দেখেই আব্বা হা-হুতাশ করতে লাগলেন। বলতে লাগলেন, এই কি সর্বনাশ অইছেরে নাম, নাম। হায় হায়রে কই গিয়া উঠছেরে! নামলে না, গাছেতে পইরা মরবে। তাড়াতাড়ি নাম। কথাগুলো ছিল অত্যন্ত মধুর ও আব্বার আদরমাখা। পরে দ্রুত নামি। আরেকবার আমাদের বাড়ির উত্তরে বাইদের খেতে কামলারা ধান কাটতেছিল। আমি আর আব্বা খেতের আইলে বসে আলাপ করতেছিলাম। পরে আব্বা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে হঠাৎ হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, আমার জানা মতে, আমাদের ১৪ গোষ্ঠীর কারো পেটে একটা কালা অক্ষর নাই। আমাকে দিয়ে ওই বাড়িতে প্রথম লেখাপড়া শুরু। আব্বা বললেন, এই বাড়িতে তর আগে কেউ লেহাপড়া জানতো বলে আমার জানা নাই। অহন আল্লায় আমার ঘরে কি দিল! আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। এসব বলে আব্বা জোরে জোরে কাঁদতেছিলেন। আব্বার কান্না দেখে আমার গাল বেয়ে পানি পরতেছিল। পরে জুরু খাঁ বেঠা ধান কাটা রেখে পিছন দিকে ফিরে বললেন, কি গো, হগলে দেখলাম তোমরা বাপ পুত হাসতাছো, আলাপ করতাছো, হঠাৎ অহন কি অইছে? কানতাছো কেয়া? পরে আব্বার ঘর থেকে যে ছেলে ও নাতিসহ এত এত আলেম হয়েছে এর শুকরিয়ার বিষয়টি জুরু খাঁকে আব্বা বুঝিয়ে বললেন। এ ঘটনার বর্ণনাসহ ‘আমার বাবা এখন’ শিরোনামে ইনকিলাব উপহারে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। আজ বাবা দিবসে বাবার আদর স্নেহ ও অমায়িক ভালবাসার কথা মনে পরায় দুয়েকটি কথা লিখলাম। আব্বা আজও আছেন, আম্মাও আছেন। আলহামদু লিল্লাহ। আব্বা আম্মা এতই দামী মানুষ যে, খেদমত তো দূরের কথা, তাদের মুখখানা একটু নেক নজরে দেখলেও কবুল হজ্বের সওয়াব পাওয়া যায়। আমি এখন সেদিকে যাচ্ছি না। আব্বা আম্মা দুজনই অসুস্থ্য। তারপরও শুকরিয়ার বিষয় হলো, নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজ তাঁরা এখনও নিজেরাই আঞ্জাম দিতে পারেন। ১৮ জুন বাবা দিবসে আমার বাবার জন্য সকলের দোয়া কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে সুস্থ্য রাখেন এমনকি তাঁর শেষ বিদায় যাতে ঈমানের সাথে হয়। পাশাপাশি আম্মার জন্যেও সকলের দোয়া কামনা করছি।
বাবার আদর
