মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী
দুই বছর আগের কথা। নবসৃষ্ট ময়মনসিংহ বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে পদায়নের জন্য আমরা দুই রাশেদ প্রথম ন্যস্ত হলাম। আমি আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে অবমুক্ত হয়ে বন্ধু রাশেদের কয়েকদিন আগেই কমিশনার স্যারের কার্যালয়ে যোগদান করি। আমার পোস্টিং হয় ফুলপুর উপজেলায়। কিন্তু স্যার আমাকে কয়েকদিন পরে ফুলপুরে যেতে বললেন। এই সময়ে রাশেদও ডিসি অফিস থেকে অবমুক্ত হয়ে জয়েন করে। রাশেদের পোস্টিং হলো ত্রিশাল। তার অফিস আদেশটাও আমার নিজ হাতে টাইপ করা। আমরা একসাথে ফাউন্ডেশন ও ল’ ট্রেনিং করেছি। সে হিসেবে তার সাথে আগে থেকেই খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ময়মনসিংহ জেলায় আবার একই সাথে ইউএনও। ভালো একটা অনুভূতি। যোগদানের পর খুব বেশি যে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি তা নয়। এর মধ্যেই মার্চের শেষে মিড ক্যারিয়ার ট্রেনিং -এ ভারত চলে যেতে হলো। ট্রেনিংয়ের সময় একদিন সন্ধ্যায় আমার রুমমেট সাইদ জানালো, রাশেদের কি যেন হয়েছে। মোবাইল ওপেন করতেই একি দেখলাম! ত্রিশালের ইউএনও রাশেদ আর নেই। সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত! বলা বাহুল্য যে, আমাদের ব্যাচ -এ বেশ কয়েকজন রাশেদ। এরই মধ্যে আবার কয়েকজন আমার ছবি দিয়েও পোস্ট দিয়েছে। পরে শুনেছিলাম অনেকে সে সময় আমার মোবাইলে রিং দিয়ে রেস্পন্স না পেয়ে এরকম ধারণা করেছিল। সেদিন থেকে আজ অবধি আমাদের বন্ধুরা রাশেদের কথা ভুলতে পারিনি।
ভারতে থাকার কারণে রাশেদের জানাজায় থাকতে পারিনি। কাজের ব্যস্ততায় যেতে পারিনি তার মৃত্যুবার্ষিকীতেও। এর মধ্যে কয়েকবার তার বাবার সাথে দেখা হয়েছে। শুধু বলেছিলাম, আমার নামও রাশেদ। একথা শুনেই কিনা জানিনা, তিনি আমাকে প্রায়ই ফোন দেন। কবে তাদের বাড়িতে যাব তা জানতে চান। নিজেকে প্রায়শই অপরাধী মনে হয়। একজন বাবা তার সন্তান রাশেদকে হারিয়ে হয়তো অন্য এক রাশেদের মধ্যে তার ছায়া দেখতে চান।
রাশেদের মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগেই আমার বাবা মারা যান। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, ইউএনও’র লাল গাড়ীতে করে আমার কর্মস্থলে নিয়ে যাব। সেটা হয়ে উঠেনি। রাশেদের বাবা হয়তো দেখেছেন। সেটা ক্ষণিকের তরে। কোথায় যেন দুঃখের একটা মিল আছে।
অবশেষে গতকাল সপরিবারে রাশেদের বাবাকে দেখতে গেলাম। আমার ব্যাচমেটরা আমার থেকে অনেক ভালো। তারা অনেকেই রাশেদ, রাজিব আর মার্ডির পরিবারের খবর রাখে। রাশেদের পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে রেহানা কলি, রিপন আরো অনেকেই। গতকাল রাতেও রেহানা আমাদের সাথে করে নিয়ে গেছে। রাশেদের মা বাসায় ছিলেন না। তবে ফোনে নিয়েছেন। আমার মেয়ে আরিবাকে চাচা হাত ধরে উঠানে ঘুরিয়েছেন। প্রথমে সে যেতে চাচ্ছিল না। যখন বললাম যে, দেখতো তাকে তোমার দাদার মতো লাগে কিনা? তোমার দাদারও ছিল সাদা দাড়ি আর মাথায় টুপি। তখন সে কি মনে করে তার সাথে চলা শুরু করলো। চাচা পুরো বাসা আমাকে ঘুরিয়ে দেখালেন। ওই ঘরগুলোতে ছিল রাশেদের বিচরণ। এই অন্ধকার গ্রামের অতি সাধারণ এক পরিবারের অসাধারণ এক ছেলে রাশেদ। সব সময় মুখে হাসি রেখে নিজের হাজারো কষ্ট চেপে রাখা রাশেদকে আল্লাহ যেন পরকালে অনেক অনেক ভালো রাখেন। রাশেদের জন্য ভালবাসা।
লেখক : ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
একজন রাশেদের জন্য ভালবাসা
